ইসলামে শবে কদর বা লাইলাতুলকদর একটি মহিমান্বিত রাত। এ রাতের চেয়ে মর্যাদাপূর্ণ কোনো রাত নেই। শবে কদর এর অর্থ কি ?“শবে কদর” কথাটি ফারসি। ‘শব’ অর্থ : রাত বা রজনী আর ‘কদর’ অর্থ : সম্মান, মর্যাদা, গুনাগুন, সম্ভাবনা ও ভাগ্য ইত্যাদি। অর্থাৎ শবে কদরের অর্থ হচ্ছে- ভাগ্যের রজনী বা সম্মানিত রাত ইত্যাদি। শবে কদরের আরবি হলো- লাইলাতুলকদর তথা সম্মানিত রাত। লাইলাতুলকদরের রাত হচ্ছে হাজার মাসের চেয়ে উত্তম রাত। তাই এই রাত্রি মুসলমানদের জন্য ভাগ্য রজনী হিসেবে সম্মানিত।
□ শবে কদরের ফজীলত হলো-পবিত্র কুরআনুল কারীম নাযিলের মাধ্যমে আল্লাহ এ রাতকে হাজার মাসের চেয়েও শ্রেষ্ঠ রাত বা মহামান্বিত রাত হিসেবে আমাদের জন্য দান করেছেন। প্রতিবছর রমজান মাসের শেষ দশকের রাতগুলোর মধ্যে কোন এক বিঝুড় রাত হল ভাগ্য নির্ধারণ বা লাইলাতুলকদরের রাত।
পবিত্র কোরআন ঘোষণা করছে-
إِنَّآ أَنزَلۡنَٰهُ فِي لَيۡلَةِ ٱلۡقَدۡرِ٠وَمَاۤ اَدْرٰىكَ مَا لَیْلَةُ الْقَدْرِؕ٠لَيۡلَةُ ٱلۡقَدۡرِ خَيۡرٞ مِّنۡ أَلۡفِ شَهۡرٖ٠تَنَزَّلُ ٱلۡمَلَٰٓئِكَةُ وَٱلرُّوحُ فِيهَا بِإِذۡنِ رَبِّهِم مِّن كُلِّ أَمۡرٖ٠سَلَٰمٌ هِيَ حَتَّىٰ مَطۡلَعِ ٱلۡفَجۡرِ٠
নিশ্চয় আমি এটি (কোরআন)নাযিল করেছি লাইলাতুল কদরে (হে,রাসূল))তুমি কি জানো, কদরের রাত কি? লায়লাতুল কদর এক হাজার মাস থেকে উত্তম অর্থাৎ লায়লাতুল কদরে আমল করা লায়লাতুল কদরের বাইরে এক হাজার মাস আমল করার চেয়েও উত্তম। সেরাতে ফেরেশতারা ও রূহ জিব্রীল আ.তাদের রবের অনুমতিক্রমে সকল সিদ্ধান্ত নিয়ে অবতরণ করে। শান্তিময় সেই রাত, ফজরের সূচনা পর্যন্ত।[সূরা আল কাদর-১-৫]
অর্থাৎ লায়লাতুল কদরের পুরোটাই ভালো, এর শুরু থেকে সুবেহ সাদেক পর্যন্ত আদৌ কোনো অনুত্তম বিষয় নেই।
অন্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন-
إِنَّآ أَنزَلۡنَٰهُ فِي لَيۡلَةٖ مُّبَٰرَكَةٍۚ إِنَّا كُنَّا مُنذِرِينَ٠فِيهَا يُفۡرَقُ كُلُّ أَمۡرٍ حَكِيمٍ.
নিশ্চয় আমি এটি নাযিল করেছি বরকতময় রাতে; নিশ্চয় আমি সতর্ককারী। সে রাতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত অনুমোদিত হয়।
[সূরা দুখান-৩,৪]
উক্ত আয়াতে ‘লায়লাতুম মুবারাকা’- এর অর্থ ইবনে আব্বাস রা.এর নিকট লায়লাতুল কদর।
★সূরা কদরের আয়াতের শানে নুযূল:-
রাসূল সা.একদিন সাহাবায়ে কেরামদের রা.সামনে বনি ইসরাইলের এক ইবাদত কারী ব্যাক্তির কথা উল্লেখ করে বলছিলেন যে,সে ব্যক্তি এক হাজার মাস ধরে আল্লাহর ধ্যান ও সাধনায় লিপ্ত ছিল। এ কথা শুনে সাহাবায়ে কেরাম রা. আফসোস করতে লাগলেন-আর বললেন, আমরা এত বছর ইবাদত করব কীভাবে? তা ছাড়া আমাদের অনেকে তো এত বছর বেঁচেও থাকি না। ঠিক তখনই জিবরাইল আ.এ রাতের সুসংবাদসহ সুরা কদর নিয়ে রাসূল সা.কাছে হাজির হলেন এবং এ উম্মতকে শ্রেষ্ঠ উম্মত হিসাবে প্রমাণ করে দিলেন।[তাফসিরে মাজহারি]
® রাসূল সা.এর উম্মতের হায়াত কম হাওয়ায় অল্প আমলে বেশী সাওয়াবের আর একটি হাদিস।
حَدَّثَنِي أَوْسُ بْنُ أَوْسٍ الثَّقَفِيُّ، قَالَ سَمِعْتُ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ مَنْ غَسَّلَ يَوْمَ الْجُمُعَةِ وَاغْتَسَلَ وَبَكَّرَ وَابْتَكَرَ وَمَشَى وَلَمْ يَرْكَبْ وَدَنَا مِنَ الإِمَامِ فَاسْتَمَعَ وَلَمْ يَلْغُ كَانَ لَهُ بِكُلِّ خَطْوَةٍ عَمَلُ سَنَةٍ أَجْرُ صِيَامِهَا وَقِيَامِهَا.
আওস বিন আওস আস-সাকাফী রা. থেকে বর্ণিত,আমি নবী সা.কে বলতে শুনেছি-যে ব্যক্তি জুমাআহ্র দিন (স্ত্রী সহবাসজনিত) গোসল করলো এবং নিজে গোসল করলো এবং সকাল সকাল যানবাহন ছাড়া পদব্রজে মাসজিদে এসে ইমামের কাছিাকাছি বসলো, মনোযোগ সহকারে প্রথম থেকে খুতবাহ শুনলো এবং অনর্থক কিছু করলো না, তার জন্য প্রতি কদমে এক বছরের সওম রাখ ও তার রাত জেগে সালাত পড়ার সমান নেকী রয়েছে। [তিরমিযী-৪৯৬,নাসায়ী- ১৩৮১,আবূদাঊদ-৩৪৫,ইবনে মাজা- ১০৮৭,মিশকাত-১৩৮৮]
□ হাদীসে বর্ণিত কদরের রাতের ফজিলত।
১.যে ব্যক্তি ছাওয়াবপ্রাপ্তির দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে ও আল্লাহর সন্তুষ্টির আশায় লায়লাতুল কদর যাপন করবে তার অতীতের সকল গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে।
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رضى الله عنه عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ مَنْ صَامَ رَمَضَانَ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ، وَمَنْ قَامَ لَيْلَةَ الْقَدْرِ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ.
আবূ হুরায়রা রা.থেকে বর্ণিত,নবী সা. বলেছেন-যে ব্যক্তি রমযানে ঈমানের সাথে ও সওয়াব লাভের আশায় সাওম পালন করে, তার পূর্ববর্তী গুনাহসমূহ মাফ করে দেয়া হয় এবং যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে, সওয়াব লাভের আশায় লাইলাতুল কদরে রাত জেগে ইবাদত করে, তার পূর্ববর্তী গুনাহসমূহ মাফ করে দেয়া হয়।[বুখারী-২০১৪]
২.ঠিক কত তারিখে এই রাতের অবস্থান তা কেউ জানে না। তবে কোন রাতটি লাইলাতুল কদর এ সম্পর্কে হাদীসে নিম্নবর্ণিত বাণী রয়েছে:
[১] রমজানের শেষ দশকে এই রাতের অনুসন্ধানের নির্দেশ এসেছে।
عَنْ عَائِشَةَ، قَالَتْ كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يُجَاوِرُ فِي الْعَشْرِ الأَوَاخِرِ مِنْ رَمَضَانَ، وَيَقُولُ تَحَرَّوْا لَيْلَةَ الْقَدْرِ فِي الْعَشْرِ الأَوَاخِرِ مِنْ رَمَضَان.
আয়িশা রা.থেকে বর্ণিত,তিনি বলেন,রসূল সা.রমযানের শেষ দশকে ইতিকাফ করতেন এবং বলতেন-তোমরা রমযানের শেষ দশকে লাইলাতুল কদর অনুসন্ধান কর।[বুখারী-২০২০,মুসলিম: ১১৬৯]
[২] আর এটি রমজানের শেষ দশকের বেজোড় রাতে হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
عَنْ عَائِشَةَ رضى الله عنها أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ تَحَرَّوْا لَيْلَةَ الْقَدْرِ فِي الْوِتْرِ مِنَ الْعَشْرِ الأَوَاخِرِ مِنْ رَمَضَانَ.
আয়িশা রা.থেকে বর্ণিত,রাসূল সা. বলেছেন-তোমরা রমযানের শেষ দশকের বেজোড় রাতে লাইলাতুল কদরের অনুসন্ধান কর।[বুখারী-২০১৭
[৩] কদরের রাত একুশ তম রজনীও হতে পারে।
عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ، عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ الْتَمِسُوهَا فِي الْعَشْرِ الأَوَاخِرِ مِنْ رَمَضَانَ فِي تَاسِعَةٍ تَبْقَى وَفِي سَابِعَةٍ تَبْقَى وَفِي خَامِسَةٍ تَبْقَى.
ইবনু আব্বাস রা.থেকে বর্ণিত,নবী সা. ল
বলেন-তোমরা রমাযানের শেষ দশকে ‘লাইলাতুল ক্বদর’ অন্বেষণ করো। রমাযানের নয় দিন বাকী থাকতে, সাত দিন বাকী থাকতে এবং পাঁচদিন বাকী থাকতে।[আবু দাউদ-১৩৮১]
[৪] কদরের রাত তেইশ রজনী ও হতে পারে।
عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ أُنَيْسٍ، أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ أُرِيتُ لَيْلَةَ الْقَدْرِ ثُمَّ أُنْسِيتُهَا وَأَرَانِي صُبْحَهَا أَسْجُدُ فِي مَاءٍ وَطِينٍ. قَالَ فَمُطِرْنَا لَيْلَةَ ثَلاَثٍ وَعِشْرِينَ فَصَلَّى بِنَا رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم فَانْصَرَفَ وَإِنَّ أَثَرَ الْمَاءِ وَالطِّينِ عَلَى جَبْهَتِهِ وَأَنْفِهِ. قَالَ وَكَانَ عَبْدُ اللَّهِ بْنُ أُنَيْسٍ يَقُولُ ثَلاَثٍ وَعِشْرِينَ .
আবদুল্লাহ ইবনু উনায়স রা.থেকে বর্ণিত যে,রাসুল সা.বলেন, আমাকে কদরের রাত দেখান হয়েছিল। অতঃপর তা ভুলিয়ে দেয়া হয়েছে। আমাকে ঐ রাতের ভোর সম্পর্কে স্বপ্নে আরও দেখান হয়েছে যে, আমি পানি ও কাদার মধ্যে সিজদা করছি। রাবী বলেন, অতএব ২৩তম রাতে বৃষ্টি হল এবং রাসুল সা.আমাদের সাথে ফজরের সালাত আদায় করে যখন ফিরলেন, তখন আমরা তাঁর কপাল ও নাকের ডগায় কাদা ও পানির চিহ্ন দেখতে পেলাম। রাবী বলেন, আবদুল্লাহ ইবনু উনায়স রা.বলতেন, তা ছিল ২৩তম।[মুসলিম-১১৬৮ আহমদ-১৬০৪৫]
[৫] ২৪তম রজনী ও কদরের রাত হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে।
عَنْ عِكْرِمَةَ عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ الْتَمِسُوا فِي أَرْبَعٍ وَعِشْرِينَ.
ইকরামা রহ.ইবনু আব্বাস রা.হতে অন্য সূত্রে বর্ণিত যে,তোমরা ২৪তম রাতে তালাশ কর।[বুখারী-২০২২]
[৬] কদরের রাত ২৫তম রজনীতে হওয়ার ও সম্ভবনা রয়েছে।
عَنْ عُبَادَةَ بْنِ الصَّامِتِ، قَالَ خَرَجَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم لِيُخْبِرَنَا بِلَيْلَةِ الْقَدْرِ، فَتَلاَحَى رَجُلاَنِ مِنَ الْمُسْلِمِينَ، فَقَالَ خَرَجْتُ لأُخْبِرَكُمْ بِلَيْلَةِ الْقَدْرِ، فَتَلاَحَى فُلاَنٌ وَفُلاَنٌ، فَرُفِعَتْ، وَعَسَى أَنْ يَكُونَ خَيْرًا لَكُمْ، فَالْتَمِسُوهَا فِي التَّاسِعَةِ وَالسَّابِعَةِ وَالْخَامِسَةِ.
উবাদা ইবনুস সামিত রা.থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,একদা নবী সা.আমাদেরকে লাইলাতুল ক্বাদরের (নির্দিষ্ট তারিখ) অবহিত করার জন্য বের হয়েছিলেন। তখন দুজন মুসলমান ঝগড়া করছিল। তা দেখে তিনি বললেন-আমি তোমাদেরকে লাইলাতুল ক্বাদরের সংবাদ দিবার জন্য বের হয়েছিলাম, তখন অমুক অমুক ঝগড়া করছিল, ফলে তার (নির্দিষ্ট তারিখের) পরিচয় হারিয়ে যায়। সম্ভবতঃ এর মধ্যে তোমাদের জন্য কল্যাণ নিহিত রয়েছে। তোমরা নবম, সপ্তম ও পঞ্চম রাতে তা তালাশ কর।[বুখারী-২০২৩]
[৭] এ রাত রমজানের শেষের সাত দিনে হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
عَنِ ابْنِ عُمَرَ رضى الله عنهما أَنَّ رِجَالاً، مِنْ أَصْحَابِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم أُرُوا لَيْلَةَ الْقَدْرِ فِي الْمَنَامِ فِي السَّبْعِ الأَوَاخِرِ، فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم. أَرَى رُؤْيَاكُمْ قَدْ تَوَاطَأَتْ فِي السَّبْعِ الأَوَاخِرِ، فَمَنْ كَانَ مُتَحَرِّيَهَا فَلْيَتَحَرَّهَا فِي السَّبْعِ الأَوَاخِرِ.
ইবনু উমর রা.থেকে বর্ণিত,নবী সা.এর কতিপয় সাহাবীকে স্বপ্নের মাধ্যমে রমযানের শেষের সাত রাত্রে লাইলাতুল কদর দেখানো হয়। এ শুনে আল্লাহর রাসূল সা.বলেন-আমাকেও তোমাদের স্বপ্নের অনুরূপ দেখানো হয়েছে।তোমাদের দেখা ও আমার দেখা শেষ সাত দিনের ক্ষেত্রে মিলে গেছে। অতএব যে ব্যক্তি এর সন্ধান প্রত্যাশী,সে যেন শেষ সাত রাতে সন্ধান করে।[বুখারী-২০১৫, মুসলিম-১১৬৫]
[৮] রমাযানের ২৭ শে রজনী লাইলাতুল কদর হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি।
(ক) উবাই ইবনে কাব হতে বর্ণিত হাদীসে এসেছে,
عَنْ زِرِّ بْنِ حُبَيْشٍ قَالَ سَأَلْتُ أُبَيَّ بْنَ كَعْبٍ فَقُلْتُ إِنَّ أَخَاكَ ابْنَ مَسْعُودٍ يَقُولُ مَنْ يَقُمِ الْحَوْلَ يُصِبْ لَيْلَةَ الْقَدْرِ. فَقَالَ رَحِمَهُ اللهُ أَرَادَ أَنْ لَا يَتَّكِلَ النَّاسُ أَمَا إِنَّه قَدْ عَلِمَ أَنَّهَا فِىْ رَمَضَانَ وَأَنَّهَا فِى الْعَشْرِ الْأَوَاخِرِ وَأَنَّهَا لَيْلَةُ سَبْعٍ وَعِشْرِينَ ثُمَّ حَلَفَ لَا يَسْتَثْنِىْ أَنَّهَا لَيْلَةُ سَبْعٍ وَعِشْرِينَ. فَقُلْتُ بِأَىِّ شَىْءٍ تَقُولُ ذٰلِكَ يَا أَبَا الْمُنْذِرِ؟ قَالَ بِالْعَلَامَةِ أَوْ بِالْاٰيَةِ الَّتِىْ أَخْبَرَنَا رَسُوْلُ اللّٰهِ ﷺ إِنَّهَا تَطْلُعُ يَوْمَئِذٍ لَا شُعَاعَ لَهَا.
যির ইবনু হুবায়শ রা.থেকে বর্ণিত,তিনি বলেন,আমি উবাই ইবনু কা‘বকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনার (দীনী) ভাই আবদুল্লাহ ইবনু মাসঊদ রা. বলেন, যে ব্যক্তি গোটা বছর ইবাদাত করার জন্য রাত জাগরণ করবে, সে ‘কদর রজনী’ পাবে। উবাই ইবনু কা‘ব বলেন, আল্লাহ ইবনু মাসঊদ এর ওপর রহম করুন। তিনি এ কথাটা এজন্য বলেছেন, যেন মানুষ ভরসা করে বসে না থাকে। নতুবা তিনি তো জানেন যে, ‘কদর’ রমজান মাসেই আসে। আর রমজান মাসের শেষ দশ দিনের এক রাতে কদর রজনী হয়। সে রাতটা সাতাশতম রাত। এদিকে উবাই ইবনু কাব কসম করেছেন এবং ইনশাল্লাহ’ বলা ছাড়াই বলেছেন,নিঃসন্দেহে কদর রাত রমজানের সাতাশতম রাত। আমি আরয করলাম, হে আবূল মুনযির (উবাই-এর ডাক নাম)! কিসের ভিত্তিতে আপনি এ কথা বলেছেন? তিনি বললেন, ঐ আলামাত ও আয়াতের ভিত্তিতে, যা আমাদেরকে রসূল সা.বলেছেন। (তিনি বলেছেন), ঐ রাতের সকালে সূর্য উদয় হবে, কিন্তু এতে কিরণ বা থাকবে না।[মুসলিম-৭৬২,মিশকাত-২০৮৮]
(খ) আব্দুল্লাহ বিন উমার রা.থেকে বর্ণিত,
হাদিস এসেছে।
عن ابن عمر رضي الله عنهما قال: قال رسول الله ﷺ مَنْ كَانَ مُتَحَرِّيْهَا فَلْيَتَحَرِّهَا لَيْلَةَ السَّبْعِ وَالْعِشْرِيْنَ
আব্দুল্লাহ বিন উমার রা.থেকে বর্ণিত, রাসূল সা.বলেছেন-যে ব্যক্তি কদরের রাত অর্জন করতে ইচ্ছুক, সে যেন তা রমাজানের ২৭ শে রজনীতে অনুসন্ধান করে।[আহমাদ-৪৮০৮]
▪ উপরের হাদীস গুলো দ্বারা আমরা এই সিদ্ধান্ত নিতে পারি যে,কদরের রাত হওয়ার ব্যাপারে সম্ভাবনার দিক থেকে সম্ভাবনা হল-২১তারিখ,২৩ তারিখ,২৪ তারিখ,২৫ তারিখ,২৭তারিখ ও ২৯ তারিখের রজনী।
▪ সর্বশেষ আরেকটি মত হল- মহিমান্বিত এ রজনীর সময় পরিবর্তনশীল। অর্থাৎ প্রতি বৎসর একই তারিখে বা একই রজনীতে তা হয় না এবং শুধুমাত্র ২৭ তারিখেই এ রাতটি আসবে তা নির্ধারিত নয়। আল্লাহর হিকমত ও তাঁর ইচ্ছায় কোন বছর তা ২৫ তারিখে, কোন বছর ২৩ তারিখে, কোন বছর ২১ তারিখে, আবার কোন বছর ২৯ তারিখেও হয়ে থাকে
৩.যে ব্যক্তি এরাতের কল্যাণ থেকে বঞ্চিত রয়ে গেল সে প্রকৃত বঞ্চিত হয়েই রয়ে গেল।
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ.أَتَاكُمْ رَمَضَانُ شَهْرٌ مُبَارَكٌ فَرَضَ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ عَلَيْكُمْ صِيَامَهُ، تُفْتَحُ فِيهِ أَبْوَابُ السَّمَاءِ، وَتُغْلَقُ فِيهِ أَبْوَابُ الْجَحِيمِ، وَتُغَلُّ فِيهِ مَرَدَةُ الشَّيَاطِينِ، لِلَّهِ فِيهِ لَيْلَةٌ خَيْرٌ مِنْ أَلْفِ شَهْرٍ، مَنْ حُرِمَ خَيْرَهَا فَقَدْ حُرِمَ.
আবূ হুরায়রা রা.থেকে বর্ণিত,তিনি বলেন- রাসুল সা.বলেছেন যে, তোমাদের নিকট রমযান উপস্থিত হয়েছে, যা একটি বরকতময় মাস। তোমাদের উপরে আল্লাহ অত্র মাসের সওম ফরয করেছেন। এ মাসের আগমনে জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হয়, জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেয়া হয়, আর আল্লাহর অবাধ্য শয়তানদের গলায় লোহার বেড়ী পরানো হয়। এ মাসে একটি রাত রয়েছে যা এক হাজার মাস অপেক্ষাও উত্তম। যে ব্যক্তি সে রাতের কল্যাণ থেকে বঞ্চিত রয়ে গেল সে প্রকৃত বঞ্চিত রয়ে গেল।[নাসায়ী- ২১০৬,ইবনে মাজা-১৬৪৪]
■ লাইলাতুল কদর অনুসন্ধানের অর্থ হলো-আল্লাহর দরবারে এই রাতের কল্যাণ লাভের প্রার্থনা করা,নিজের ভুল- ত্রুটির জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা। যেন আল্লাহ পাপের কারণে লাইলাতুল কদরের বরকত থেকে বঞ্চিত না করেন।
● বিশেষ ফজিলতপূর্ণ এই রাতের কিছু আমল:-
১. বেশি বেশি ক্ষমা প্রার্থনা করা।
عَنْ عَائِشَةَ، قَالَتْ قُلْتُ يَا رَسُولَ اللَّهِ أَرَأَيْتَ إِنْ عَلِمْتُ أَىُّ لَيْلَةٍ لَيْلَةُ الْقَدْرِ مَا أَقُولُ فِيهَا قَالَ قُولِي اللَّهُمَّ إِنَّكَ عَفُوٌّ كَرِيمٌ تُحِبُّ الْعَفْوَ فَاعْفُ عَنِّي.
আয়িশা রা.থেকে বর্ণিত,তিনি বলেন, আমি বললাম,হে আল্লাহর রাসূল! যদি আমি “লাইলাতুল কদর’’ জানতে পারি তাহলে সে রাতে কি বলব? তিনি বলেন- তুমি বল হে আল্লাহ! তুমি সম্মানিত ক্ষমাকারী, তুমি মাফ করতেই পছন্দ কর, অতএব তুমি আমাকে মাফ করে দাও।[ইবনু মাজা- ৩৮৫০, তিরমিজি-৩৫১৩]
২.বেশী বেশী ইসতিগফার পড়া।
فَقُلْتُ اسْتَغْفِرُوا رَبَّكُمْ إِنَّهُ كَانَ غَفَّارًا٠ يُرْسِلِ السَّمَاء عَلَيْكُم مِّدْرَارًا٠ وَيُمْدِدْكُمْ بِأَمْوَالٍ وَبَنِينَ وَيَجْعَل لَّكُمْ جَنَّاتٍ وَيَجْعَل لَّكُمْ أَنْهَارًا٠
বলেছিঃ তোমাদের রবের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর, তিনিতো মহা ক্ষমাশীল।,তিনি তোমাদের জন্য প্রচুর বৃষ্টিপাত করবেন।এবং তিনি তোমাদেরকে সমৃদ্ধ করবেন ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততিতে এবং তোমাদের জন্য স্থাপন করবেন উদ্যান ও প্রবাহিত করবেন নদী-নালা।[সূরা নুহ-১০-১২]
عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللّٰهِ ﷺ مَنْ لَزِمَ الِاسْتِغْفَارَ جَعَلَ اللّٰهُ لَه مِنْ كُلِّ ضِيقٍ مَخْرَجًا وَمِنْ كُلِّ هَمٍّ فَرَجًا وَرَزَقَه مِنْ حَيْثُ لَا يَحْتَسِبُ.
‘আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস রা.থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, রসূল সা.বলেছেন-যে ব্যক্তি সবসময় ক্ষমা চায়, আল্লাহ তার জন্য প্রত্যেক সংকীর্ণতা হতে বের হয়ে আসার পথ খুলে দেন এবং প্রত্যেক দুশ্চিন্তা হতে মুক্ত করেন। আর তাকে এমন রিযক দান করেন, যা সে কক্ষনো ভাবতেও পারবেনা।[আবূ দাঊদ ১৫১৮, ইবনু মাজাহ ৩৮১৯,মিশকাত-২৩৩৯]
এছাড়াও ইস্তেগফারের মাসনুন দোয়াগুলো যত পারেন পড়বেন।
২. কোরআন তেলাওয়াত করা:-
কদরের রাতের মর্যাদার সঙ্গে যেহেতু কোরআন নাজিলের বিষয়টি সম্পর্কিত, তাই বুজুর্গ আলেমদের মতে, কদরের রাতে কোরআন তেলাওয়াত করা তাৎপর্যপূর্ণ। ইরশাদ হয়েছে,
إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةِ الْقَدْرِ * وَمَا أَدْرَاكَ مَا لَيْلَةُ الْقَدْرِ * لَيْلَةُ الْقَدْرِ خَيْرٌ مِنْ أَلْفِ شَهْرٍ *
নিশ্চয়ই আমি কোরআন অবতীর্ণ করেছি মহিমান্বিত রজনীতে; আর মহিমান্বিত রজনী সম্বন্ধে তুমি কী জান? মহিমান্বিত রজনী সহস্র মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ।[সুরা কদর-১-৩]
৩. জামাতে ফরজ নামাজ ও তারাবি আদায়: –
কদরের রাতে জামাতের সঙ্গে মাগরিব, এশা ও ফজর নামাজ আদায় করা খুব জরুরি বিষয়। কেননা হাদিসে এসেছে-
عَنْ عُثْمَانَ بْنِ عَفَّانَ، قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم مَنْ صَلَّى الْعِشَاءَ فِي جَمَاعَةٍ كَانَ كَقِيَامِ نِصْفِ لَيْلَةٍ وَمَنْ صَلَّى الْعِشَاءَ وَالْفَجْرَ فِي جَمَاعَةٍ كَانَ كَقِيَامِ لَيْلَةٍ.
উসমান ইবনু আফফান রা.থেকে বর্ণিত,
তিনি বলেন, রসূল সা.বলেছেন-যে ব্যক্তি ইশার সলাত জামাতে আদায় করল, সে যেন অর্ধরাত ইবাদাতে কাটালো। আর যে ব্যাক্তি ইশা ও ফাজরের সলাত জামাতে আদায় করল,সে যেন সারা রাতই ইবাদাতে কাটালো।[মুসলিম-৬৫৬
আবু দাউদ-৫৫,তিরমিযি ২২১]
এরপর যত পারেন নফল নামাজ পড়বেন। কিয়ামুল্লাইল করবেন। শবে কদরে কিয়ামুল্লাইলের বিশেষ গুরুত্ব ও ফজিলত রয়েছে।
▪ عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ عَنْ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ مَنْ قَامَ لَيْلَةَ الْقَدْرِ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ.
আবূ হুরায়রা রা.থেকে বর্ণিত,নবী সা. বলেছেন-যে ব্যক্তি লাইলাতুল কদরে ঈমানের সাথে সাওয়াবের আশায় রাত জেগে ‘ইবাদাত করে, তার পিছনের সমস্ত গোনাহ ক্ষমা করা হবে।[বুখারী- ১৯০১, মুসলিম-৭৬০]
৪. নবীজির প্রতি দরুদ পাঠ:-
নবীজির প্রতি দরুদ পাঠ দোয়া কবুলে সহায়ক। এক হাদিসে নবীজি বলেছেন, ‘যখন কেউ দোয়া করবে, সে যেন তার পবিত্র প্রতিপালকের প্রশংসা বর্ণনাযোগে ও আমার প্রতি দরুদ ও সালাম পেশ করে দোয়া আরম্ভ করে, তারপর যা ইচ্ছা প্রার্থনা করে।
سَمِعَ فَضَالَةَ بْنَ عُبَيْدٍ، صَاحِبَ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ سَمِعَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم رَجُلاً يَدْعُو فِي صَلاَتِهِ لَمْ يُمَجِّدِ اللَّهَ تَعَالَى وَلَمْ يُصَلِّ عَلَى النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم. عَجِلَ هَذَا. ثُمَّ دَعَاهُ فَقَالَ لَهُ أَوْ لِغَيْرِهِ إِذَا صَلَّى أَحَدُكُمْ فَلْيَبْدَأْ بِتَحْمِيدِ رَبِّهِ جَلَّ وَعَزَّ وَالثَّنَاءِ عَلَيْهِ ثُمَّ يُصَلِّي عَلَى النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم ثُمَّ يَدْعُو بَعْدُ بِمَا شَاء.
ফাদালাহ ইবনু উবাইদ রা.থেকে বর্ণিত,
একদা রসূল সা.এক ব্যক্তিকে সলাতের মধ্যে দুআকালে আল্লাহর বড়ত্ব ও গুণাবলী বর্ণনা এবং নবী সা.এর প্রতি দরূদ পাঠ করতে শুনলেন না। রসূল সা. বললেন-এ ব্যক্তি তাড়াহুড়া করেছে। অতঃপর তিনি ঐ ব্যক্তিকে অথবা অন্য কাউকে বললেন-তোমাদের কেউ সলাত আদায়কালে যেন সর্বপ্রথম তাঁর প্রভুর মহত্ব ও প্রশংসা বর্ণনা করে এবং পড়ে নবী সা.এর উপর দরূদ পাঠ করে, অতঃপর ইচ্ছানুযায়ী দুআ করে।
[আবু দাউদ-১৪৮১,তিরমিজি-৩৪৭৬]
عن علي رضي الله عنه قال كل دعاء محجوب حتى يصلَّى على النبي صلى الله عليه وسلم.
আলী রা.মারপু সুত্রে বলেন-নবী সা.এর ওপর দরুদ না পড়া পর্যন্ত যেকোনো দোয়া আটকে থাকে।[সহিহুল জামে- ৪৩৯৯]
৫. তাহাজ্জুদ আদায়:
তাহাজ্জুদ নামাজ আল্লাহর নৈকট্য লাভের অন্যতম মাধ্যম। মহানবী সা.রমজানের শেষ দশকে কদরের রাত অনুসন্ধানের নির্দেশ দিয়েছেন এবং তিনি এই দশকে রাত জেগে ইবাদত করতেন।
▪ عَنْ عَائِشَةَ رضى الله عنها قَالَتْ كَانَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم إِذَا دَخَلَ الْعَشْرُ شَدَّ مِئْزَرَهُ، وَأَحْيَا لَيْلَهُ، وَأَيْقَظَ أَهْلَهُ.
আয়িশা রা.থেকে বর্ণিত,তিনি বলেন, যখন রমযানের শেষ দশক আসত তখন নবী সা.তাঁর লুঙ্গি কষে নিতেন (বেশী বেশী ইবাদতের প্রস্তুতি নিতেন) এবং রাত্র জেগে থাকতেন ও পরিবার-পরিজনকে জাগিয়ে দিতেন।[বুখারী-২০২৪]
▪ عَنْ بِلاَلٍ، أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ عَلَيْكُمْ بِقِيَامِ اللَّيْلِ فَإِنَّهُ دَأْبُ الصَّالِحِينَ قَبْلَكُمْ وَإِنَّ قِيَامَ اللَّيْلِ قُرْبَةٌ إِلَى اللَّهِ وَمَنْهَاةٌ عَنِ الإِثْمِ وَتَكْفِيرٌ لِلسَّيِّئَاتِ وَمَطْرَدَةٌ لِلدَّاءِ عَنِ الْجَسَدِ.
বিলাল রা.থেকে বর্ণিত,রাসূল সা.বলেন- তোমরা অবশ্যই রাতের ইবাদাত করবে। কেননা তা তোমাদের পূর্ববর্তী সৎকর্মপরায়ণ বান্দাদের নিত্য আচরণ ও প্রথা। রাতের ইবাদাত আল্লাহর সান্নিধ্য অর্জনের উপায়,পাপকর্মের প্রতিবন্ধক, গুনাহসমূহের কাফফারা এবং দেহের রোগ দূরকারী। [তিরমিজি-৩৫৪৯, মিশকাত-১২২৭]
▪ নবী সা.বলেন, মুমিনের মর্যাদা কিয়ামুল লাইল তথা রাতে দাঁড়িয়ে তাহাজ্জুদ আদায় ও বিভিন্ন ইবাদত-বন্দেগির মধ্যে, আর তার সম্মান মানুষ থেকে অমুখাপেক্ষিতার মধ্যে।[তবরানি-৪২৭৮]
▪ নবী সা.বলেন, নিশ্চয়ই জান্নাতে রয়েছে এমন কিছু প্রাসাদ, যার বাইরে থেকে ভেতরাংশ দেখা যাবে, ভেতর থেকে বাইরের অংশ দেখা যাবে। এগুলো আল্লাহ তাদের জন্য প্রস্তুত করেছেন, যারা মানুষকে খাবার খাওয়ায়, কোমল ভাষায় কথা বলে, ধারাবাহিকভাবে রোজা রাখে, সালামের প্রসার ঘটায় এবং রাতে সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে, তখন তারা নামাজে দাঁড়িয়ে যায়।[মুসনাদে আহমাদ-২২৯০৫]
◇ বিশেষ দ্রষ্ঠব্য:-দোয়া বা একনিষ্ঠ ফরিয়াদ শেষ রাতে করার চেষ্টা করবেন। কেন না রাতের শেষ অংশে দোয়া কবুল বেশী হয়:
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رضى الله عنه أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ يَنْزِلُ رَبُّنَا تَبَارَكَ وَتَعَالَى كُلَّ لَيْلَةٍ إِلَى السَّمَاءِ الدُّنْيَا حِينَ يَبْقَى ثُلُثُ اللَّيْلِ الآخِرُ يَقُولُ مَنْ يَدْعُونِي فَأَسْتَجِيبَ لَهُ مَنْ يَسْأَلُنِي فَأُعْطِيَهُ مَنْ يَسْتَغْفِرُنِي فَأَغْفِرَ لَهُ
আবূ হুরায়রা রা.থেকে বর্ণিত,রাসূল সা. বলেছেন-মহামহিম আল্লাহ প্রতি রাতের শেষ তৃতীয়াংশ অবশিষ্ট থাকাকালে পৃথিবীর নিকটবর্তী আসমানে অবতরণ করে ঘোষণা করতে থাকেন-কে আছে এমন, যে আমাকে ডাকবে? আমি তার ডাকে সাড়া দিব। কে আছে এমন যে, আমার নিকট চাইবে। আমি তাকে তা দিব। কে আছে এমন যে আমার নিকট ক্ষমা চাইবে? আমি তাকে ক্ষমা করব।[বুখারি-১১৪৫]
৬. দান-সদকা করা
দান সদকা আল্লাহর রাগ প্রশমিত করে। দানশীল ব্যক্তিকে আল্লাহ বিশেষভাবে দয়া করেন। সর্বোপরি জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচার অন্যতম কার্যকর আমল হলো দান সদকা করা। রাসুল সা. বিভিন্নভাবে দান-সদকার প্রতি উৎসাহিত করেছেন, এক হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, খেজুরের একটি অংশ দান করে হলেও তোমরা জাহান্নামের আগুন থেকে বেঁচে থাকার চেষ্টা করো।[বুখারি-৬০২৩]
৭. মা-বাবা ও মৃতদের জন্য দোয়া করা
জীবিত মৃত সকল মুসলমানের জন্য দোয়া করা অনেক বড় নেক আমল। এতে কোটি কোটি নেকি যোগ হয় আমলনায়। শবে কদরের মতো রাতে এই দোয়া না পড়া উচিত হবে না। এরকম একটি দোয়া হলো-
رَبَّنَا اغْفِرْ لِي وَلِوَالِدَيَّ وَلِلْمُؤْمِنِينَ يَوْمَ يَقُومُ الْحِسَابُ
উচ্চারণ: রব্বানাগ-ফিরলী ওয়ালি ওয়ালি-দাইয়্যা ওয়ালিল মু’মিনীনা ইয়াওমা ইয়াকুমুল হিছা-ব।
অর্থ: হে আমাদের রব! আমাকে, আমার মাতা-পিতাকে এবং সব ঈমানদারকে আপনি সেই দিন ক্ষমা করে দিন, যেদিন হিসাব কায়েম করা হবে।[সুরা ইবরাহিম- ৪১]
এছাড়াও মা-বাবার জন্য কোরআনে বর্ণিত দোয়াগুলো করতে পারেন।
মৃতদের জন্য পবিত্র কোরআনের এই দোয়াটিও করা যায়-
رَبَّنَا اغْفِرْ لَنَا وَلِإِخْوَانِنَا الَّذِينَ سَبَقُونَا بِالْإِيمَانِ وَلَا تَجْعَلْ فِي قُلُوبِنَا غِلًّا لِّلَّذِينَ آمَنُوا رَبَّنَا إِنَّكَ رَؤُوفٌ رَّحِيمٌ
রাব্বানাগফিরলানা ওয়া লি ইখওয়ানিনাল্লাজিনা ছাবকুনা বিল ইমানি ওয়া লা তাঝআল ফি কুলুবিনা গিল্লাল লিল্লাজিনা আমানু রাব্বানা ইন্নাকা রাউফুর রাহিম।
অর্থ: হে আমাদের প্রভু! আমাদের ক্ষমা কর এবং আমাদের সেসব ভাইকেও ক্ষমা কর যারা আমাদের আগে ঈমান এনেছে আর মুমিনদের প্রতি আমাদের হৃদয়ে কোনো বিদ্বেষ রেখো না। হে আমাদের পালনকর্তা! নিশ্চয় তুমি অতি স্নেহশীল ও পরম করুণাময়।[সুরা হাশর-১০]
৮. কাজা নামাজ পড়া
কদরের রাতে বুদ্ধিমানের মতো একটি আমল হলো কাজা নামাজ আদায় করা। রমজানের শেষ ১০ দিন কদর তালাশে প্রতিদিন ১৭ রাকাত ফরজ নামাজের কাজা আদায় করার পরামর্শ দিয়ে থাকেন আলেমরা। কেননা লাইলাতুল কদর হলো হাজার মাসের চেয়েও বেশি বরকতময়। এমন রাতে ৫ ওয়াক্ত নামাজ কাজা পড়তে পারলে কমপক্ষে হাজার মাস তথা ৮৩ বছর ৪ মাস কাজা নামাজ আদায়ের মতোই হবে ইনশাআল্লাহ।
৯. কদরের রাত পাওয়ার সহজ ও শ্রেষ্ঠ উপায় হচ্ছে অন্তত শেষ দশ দিন ইতেকাফ করা।
ইতেকাফ কদরের রাতের বরকত লাভে সহায়ক। কেননা ইতেকাফকারী জাগতিক সব ব্যস্ততা পেছনে ফেলে মহান আল্লাহর ইবাদতে নিমগ্ন হতে পারে। এই বিষয়ে আমারা তিনটি হাদীস আলোচনা করবো।
▪ عَنْ أَبِي سَلَمَةَ، قَالَ انْطَلَقْتُ إِلَى أَبِي سَعِيدٍ الْخُدْرِيِّ فَقُلْتُ أَلاَ تَخْرُجُ بِنَا إِلَى النَّخْلِ نَتَحَدَّثْ فَخَرَجَ. فَقَالَ قُلْتُ حَدِّثْنِي مَا، سَمِعْتَ مِنَ النَّبِيِّ، صلى الله عليه وسلم فِي لَيْلَةِ الْقَدْرِ. قَالَ اعْتَكَفَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم عَشْرَ الأُوَلِ مِنْ رَمَضَانَ، وَاعْتَكَفْنَا مَعَهُ، فَأَتَاهُ جِبْرِيلُ فَقَالَ إِنَّ الَّذِي تَطْلُبُ أَمَامَكَ. فَاعْتَكَفَ الْعَشْرَ الأَوْسَطَ، فَاعْتَكَفْنَا مَعَهُ، فَأَتَاهُ جِبْرِيلُ فَقَالَ إِنَّ الَّذِي تَطْلُبُ أَمَامَكَ. فَقَامَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم خَطِيبًا صَبِيحَةَ عِشْرِينَ مِنْ رَمَضَانَ فَقَالَ مَنْ كَانَ اعْتَكَفَ مَعَ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم فَلْيَرْجِعْ، فَإِنِّي أُرِيتُ لَيْلَةَ الْقَدْرِ، وَإِنِّي نُسِّيتُهَا، وَإِنَّهَا فِي الْعَشْرِ الأَوَاخِرِ فِي وِتْرٍ، وَإِنِّي رَأَيْتُ كَأَنِّي أَسْجُدُ فِي طِينٍ وَمَاءٍ. وَكَانَ سَقْفُ الْمَسْجِدِ جَرِيدَ النَّخْلِ وَمَا نَرَى فِي السَّمَاءِ شَيْئًا، فَجَاءَتْ قَزْعَةٌ فَأُمْطِرْنَا، فَصَلَّى بِنَا النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم حَتَّى رَأَيْتُ أَثَرَ الطِّينِ وَالْمَاءِ عَلَى جَبْهَةِ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم وَأَرْنَبَتِهِ تَصْدِيقَ رُؤْيَاهُ.
আবূ সালামা রা.থেকে বর্ণিত,তিনি বলেন, আমি আবূ সাঈদ খুদরী রা.এর নিকট উপস্থিত হয়ে বললাম, আমার সঙ্গে খেজুর বাগানে চলুন, (হাদীস সংক্রান্ত) আলাপ আলোচনা করব। তিনি বেরিয়ে আসলেন। আবূ সালামা রা.বলেন, আমি তাকে বললাম,‘লাইলাতুল কাদর’ সম্পর্কে নবী সা.হতে যা শুনেছেন, তা আমার নিকট বর্ণনা করুন। তিনি বললেন,রসূল সা.রমযানের প্রথম দশ দিন ইতিকাফ করলেন। আমরাও তাঁর সঙ্গে ইতিকাফ করলাম। জিবরীল আ.এসে বললেন, আপনি যা তালাশ করছেন, তা আপনার সামনে রয়েছে। অতঃপর তিনি মধ্যবর্তী দশদিন ইতিকাফ করলেন, আমরাও তাঁর সঙ্গে ইতিকাফ করলাম। পুনরায় জিবরীল আ.এসে বললেন, আপনি যা তালাশ করছেন, তা আপনার সামনে রয়েছে। অতঃপর রমযানের বিশ তারিখ সকালে নবী সা.খুতবা দিতে দাঁড়িয়ে বললেন, যারা আল্লাহর নবীর সঙ্গে ইতিকাফ করেছেন, তারা যেন ফিরে আসেন (আবার ইতিকাফ করেন) কেননা, আমাকে স্বপ্নে ‘লাইলাতুল কাদর’ অবগত করানো হয়েছে। তবে আমাকে তা (নির্ধারিত তারিখটি) ভুলিয়ে দেয়া হয়েছে। নিঃসন্দেহে তা শেষ দশ দিনের কোন এক বেজোড় তারিখে। স্বপ্নে দেখলাম যেন আমি কাদা ও পানির উপর সিজদা করছি। তখন মসজিদের ছাদ খেজুরের ডাল দ্বারা নির্মিত ছিল। আমরা আকাশে কোন কিছুই (মেঘ) দেখিনি, একখণ্ড হালকা মেঘ আসল এবং আমাদের উপর (বৃষ্টি) বর্ষিত হল। নবী সা.আমাদের নিয়ে সালাত আদায় করলেন। এমন কি আমি রাসূল সা.এর কপাল ও নাকের অগ্রভাগে পানি ও কাদার চিহ্ন দেখতে পেলাম। এভাবেই তাঁর স্বপ্ন সত্যে রূপ লাভ করল।
[বুখারী-৮১৩]
▪ عَنْ عَائِشَةَ رضى الله عنها زَوْجِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم أَنَّ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم كَانَ يَعْتَكِفُ الْعَشْرَ الأَوَاخِرَ مِنْ رَمَضَانَ حَتَّى تَوَفَّاهُ اللَّهُ،ثُمَّ اعْتَكَفَ أَزْوَاجُهُ مِنْ بَعْدِهِ.
নবী সহধর্মিণী আয়িশা রা.থেকে বর্ণিত,
নবী সা.রমযানের শেষ দশকে ইতিকাফ করতেন। তাঁর ওফাত পর্যন্ত এই নিয়মই ছিল। এরপর তাঁর সহধর্মিণীগণও সে দিনগুলোতে ইতিকাফ করতেন।
[বুখারী-২০২৬]
▪ عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رضى الله عنه قَالَ كَانَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم يَعْتَكِفُ فِي كُلِّ رَمَضَانَ عَشْرَةَ أَيَّامٍ، فَلَمَّا كَانَ الْعَامُ الَّذِي قُبِضَ فِيهِ اعْتَكَفَ عِشْرِينَ يَوْمًا.
আবূ হুরায়রা রা.থেকে বর্ণিত,তিনি বলেন, নবী সা.প্রতি রমযানে দশ দিনের ইতিকাফ করতেন। যে বছর তিনি ইন্তিকাল করেন সে বছর তিনি বিশ দিনের ইতিকাফ করেছিলেন। [বুখারী-২০৪৪]
★লাইলাতুল কদরের আলামত বা লক্ষণ।
লাইলাতুল কদরের কিছু আলামত হাদীসে বর্ণিত আছে। সেগুলো হল :
১.রাতটি গভীর অন্ধকারে ছেয়ে যাবে না।
২.নাতিশীতোষ্ণ হবে। অর্থাৎ গরম বা শীতের তীব্রতা থাকবে না।
৩.মৃদুমন্দ বাতাস প্রবাহিত হতে থাকবে।
৪.সে রাতে ইবাদত করে মানুষ অপেক্ষাকৃত অধিক তৃপ্তিবোধ করবে।
৫.কোন ঈমানদার ব্যক্তিকে আল্লাহ স্বপ্নে হয়তো তা জানিয়েও দিতে পারেন।
৬.ঐ রাতে বৃষ্টি বর্ষণ হতে পারে।
৭.সকালে হালকা আলোকরশ্মিসহ সূর্যোদয় হবে। যা হবে পূর্ণিমার চাঁদের মত।[ইবনু খুযাইমা-২১৯০]
সর্বোপরি উপরের আলোচনা থেকে বলা যায়, লাইলাতুল কদরের গুরুত্ব অপরিসিম। সুতরাং আমাদের সবার উচিত একনিষ্টভাবে লাইলাতুল কদর তালাশ করে আল্লাহর কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নেওয়া। আল্লাহ রব্বুল আলামিন আমাদের সবাইকে লাইলাতুল কদরের রাতে গুনাহ সমুহ মাপ করিয়ে নিষ্পাপ হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।