”তারাবীর নামাজের রাকাত সংখ্যা।”
আমাদের দেশের কিছু আহলে হাদীস নামধারী ভাইরা তারাবী এর রাকাত সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে দীর্ঘদিন যাবত। তাদের দাবী সহীহ হাদীসের ভিত্তিতে কেবল ৮ রাকাত তারাবী নামাজ প্রমাণিত। দলিল হিসেবে কিছু হাদীস পেশ করে যার কোনটিই স্পষ্ট তারাবীকে বুঝায়না। এরপরও বিশ রাকাত তারাবী যা হাদীস ও সাহাবায়ে কিরামের সর্ব সম্মত ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে প্রমাণিত একে অস্বীকার করা নিতান্তই ঘাড়ত্যারামী ছাড়া
কিছু বলে মনে হয় না। রামাজান মাসে জাতিকে সুন্নত আমল থেকে বিরত রাখে এক নিকৃষ্ট পন্থায়। সেই সকল ভ্রান্ত অনুসারীদের দাবি-যুক্তি খন্ডনের নিমিত্তে আমার এই আলোচনার সুবিধার্থে লেখাটি বেশ কয়েকটি ক্রমিক নাম্বার দ্বারা সাজিয়ে লিখবো ইনশাআল্লাহ। যথা-
১.রাসূল সা.এর যোগে তারবী।
عَنْ عَائِشَةَ أُمِّ الْمُؤْمِنِينَ رضى الله عنها أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم صَلَّى ذَاتَ لَيْلَةٍ فِي الْمَسْجِدِ فَصَلَّى بِصَلاَتِهِ نَاسٌ، ثُمَّ صَلَّى مِنَ الْقَابِلَةِ فَكَثُرَ النَّاسُ، ثُمَّ اجْتَمَعُوا مِنَ اللَّيْلَةِ الثَّالِثَةِ أَوِ الرَّابِعَةِ، فَلَمْ يَخْرُجْ إِلَيْهِمْ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم، فَلَمَّا أَصْبَحَ قَالَ قَدْ رَأَيْتُ الَّذِي صَنَعْتُمْ وَلَمْ يَمْنَعْنِي مِنَ الْخُرُوجِ إِلَيْكُمْ إِلاَّ أَنِّي خَشِيتُ أَنْ تُفْرَضَ عَلَيْكُمْ، وَذَلِكَ فِي رَمَضَانَ.
উম্মুল মুমিনীন আয়িশা রা.থেকে বর্ণিত,
তিনি বলেন,রাসূল সা.এক রাতে মসজিদে সালাত আদায় করছিলেন, কিছু লোক তাঁর সাথে সালাত আদায় করল। পরবর্তী রাতেও তিনি সালাত আদায় করলেন এবং লোক আরো বেড়ে গেল। অতঃপর তৃতীয় কিংবা চতুর্থ রাতে লোকজন সমবেত হলেন, কিন্তু রাসূল সা. বের হলেন না। সকাল হলে তিনি বললেন- তোমরা যা করেছ আমি লক্ষ্য করেছি। তোমাদের নিকট বেরিয়ে আসার ব্যাপারে এ আশঙ্কাই আমাকে বাধা দিয়েছে যে, তোমাদের উপর তা ফরজ হয়ে যাবে। এটা ছিল রমযান মাসের ঘটনা।
[বুখারী-১১২৯]
২.রাসূল সা.তারবীর নমাজের জন্য উৎসাহ করতেন তবে বাধ্য করতেন না।
এই অবস্থা ছিল আবুবক ও উমর রা.প্রথম যোগ পর্যন্ত।
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يُرَغِّبُ فِي قِيَامِ رَمَضَانَ مِنْ غَيْرِ أَنْ يَأْمُرَهُمْ فِيهِ بِعَزِيمَةٍ فَيَقُولُ مَنْ قَامَ رَمَضَانَ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ . فَتُوُفِّيَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم وَالأَمْرُ عَلَى ذَلِكَ ثُمَّ كَانَ الأَمْرُ عَلَى ذَلِكَ فِي خِلاَفَةِ أَبِي بَكْرٍ وَصَدْرًا مِنْ خِلاَفَةِ عُمَرَ عَلَى ذَلِكَ .
আবূ হুরায়রা রা.থেকে বর্ণিত,তিনি বলেন, রসূল সা.দৃঢ় বা কঠোরভাবে নির্দেশ না দিয়ে রমাযান মাসের তারাবীহ পড়তে উৎসাহিত করে বলতেন-যে ব্যক্তি ঈমানসহ ও একান্ত আল্লাহর সন্তষ্টির নিমিত্তে রমাযান মাসের তারাবীহ পড়ল তার পূর্বের সব পাপ ক্ষমা করে দেয়া হয়। অতঃপর রসূল সা.মৃত্যুবরণ করলেন। তখনও এ অবস্থা চলছিল (অর্থাৎ মানুষকে তারাবীহ পড়তে নির্দেশ না দিয়ে শুধু উৎসাহিত করা হত)। আবূ বকর রা. এর খিলাফতকালে এবং উমার রা.এর খিলাফতের প্রথম দিকেও এ নীতি কার্যকর ছিল।[মুসলিম-ই.ফা.১৬৫০, মুসলিম-১৬৬৫,অ্যাপ]
★যারা তারীর নামাজ বিশ রাকাত মানেন না তারা তারাবী ও তাহাজ্জদকে এক নামাজ বলে। এগার মাস যে নামাজ ছিল তাহাজ্জদ সেই নামাজ রমজানে এসে হয়ে যায় তারাবী। রাতের শুরু ভাগে পড়লে যার নাম তারাবী, সেই নামাজই শেষ ভাগে পড়লে নাম হয় তাহাজ্জুদ। অর্থাৎ তাদের বক্তব্য হল, তারাবী তাহাজ্জদ একই নামাজ। যেহেতু তাহাজ্জদ আট রাকাত তাই তারাবীও আট রাকাত।
এই মতের পক্ষে তাদের প্রকাশিত বইয়ের দুটি উদ্ধৃতি পেশ করি:
১) শায়েখ আসাদুল্লাহ গালিব তার রচিত নামাজ বইয়ে লিখেছেন “রাত্রির বিশেষ নফল সালাত তারাবী ও তাহাজ্জুদ নামে পরিচিত। রমজানে এশার পর প্রথম রাতে পড়লে তাকে তারাবী আর রমজানও অন্যান্য সময়ে শেষ রাতে পড়লে তাকে তাহাজ্জুদ বলে।[ছালাতুর রাসূল সা.-১৭১]
২) রমজান ছাড়া অন্য মাসে যাকে তাহাজ্জদ বলা হয়, রামাজান মাসে তাকেই তারাবী বলে।[সহীহ নামাজ ও দুআ শিক্ষা-১৭১]
লামাযহাবী ভাইদের লেখা যে কোন তারাবী সংক্রান্ত বই খুলে দেখুন একই বক্তব্য পাবেন।
৩.উমার রা.মধ্য যোগ থেকে তারবীর নামাজ।
عَنْ عَبْدِ الرَّحْمَنِ بْنِ عَبْدٍ الْقَارِيِّ، أَنَّهُ قَالَ خَرَجْتُ مَعَ عُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ رضى الله عنه لَيْلَةً فِي رَمَضَانَ، إِلَى الْمَسْجِدِ، فَإِذَا النَّاسُ أَوْزَاعٌ مُتَفَرِّقُونَ يُصَلِّي الرَّجُلُ لِنَفْسِهِ، وَيُصَلِّي الرَّجُلُ فَيُصَلِّي بِصَلاَتِهِ الرَّهْطُ فَقَالَ عُمَرُ إِنِّي أَرَى لَوْ جَمَعْتُ هَؤُلاَءِ عَلَى قَارِئٍ وَاحِدٍ لَكَانَ أَمْثَلَ. ثُمَّ عَزَمَ فَجَمَعَهُمْ عَلَى أُبَىِّ بْنِ كَعْبٍ، ثُمَّ خَرَجْتُ مَعَهُ لَيْلَةً أُخْرَى، وَالنَّاسُ يُصَلُّونَ بِصَلاَةِ قَارِئِهِمْ، قَالَ عُمَرُ نِعْمَ الْبِدْعَةُ هَذِهِ، وَالَّتِي يَنَامُونَ عَنْهَا أَفْضَلُ مِنَ الَّتِي يَقُومُونَ. يُرِيدُ آخِرَ اللَّيْلِ، وَكَانَ النَّاسُ يَقُومُونَ أَوَّلَهُ.
আবদুর রাহমান ইবনু আবদ আল-ক্বারী রহ.থেকে বর্ণিত,তিনি বলেন, আমি রমজানের এক রাতে উমর ইবনুল খাত্তাব রা.এর সাথে মসজিদে নাবাবীতে গিয়ে দেখি যে,লোকেরা এলোমেলোভাবে জামাতে বিভক্ত। কেউ একাকী সালাত আদায় করছে আবার কোন ব্যক্তি সালাত আদায় করছে এবং ইকতেদা করে একদল লোক সালাত আদায় করছে। উমর রা.বললেন,আমি মনে করি যে, এই লোকদের যদি আমি একজন ক্বারীর (ইমামের) পিছনে জমা করে দেই, তবে তা উত্তম হবে। এরপর তিনি উবাই ইবনু কাব রা.এর পিছনে সকলকে জমা করে দিলেন। পরে আর এক রাতে আমি তাঁর [উমর রা.] সাথে বের হই। তখন লোকেরা তাদের ইমামের সাথে সালাত আদায় করছিল। উমর রা.বললেন,কত না সুন্দর এই নতুন ব্যবস্থা! তোমরা রাতের যে অংশে ঘুমিয়ে থাক তা রাতের ঐ অংশ অপেক্ষা উত্তম যে অংশে তোমরা সালাত আদায় কর, এর দ্বারা তিনি শেষ রাত বুঝিয়েছেন, কেননা তখন রাতের প্রথমভাগে লোকেরা সালাত আদায় করত।[বুখারী-২০১০]
® আবুল আলিয়া রহ.এর বর্ণনা
عن أبي بن كعب أن عمر أمر أبيا أن يصلي بالناس في رمضان فقال إن الناس يصومون النهار ولا يحسنون أن يقرؤا فلو قرأت القرآن عليهم بالليل فقال يا أمير المؤمنين هذا شيء لم يكن فقال قد علمت ولكنه أحسن فصلى بهم عشرين ركعة
হযরত উবাই ইবনে কাব রা.থেকে বর্ণিত, উমর রা.আমাকে আদেশ করেছিলেন, আমি যেন রমজান মাসে লোকদের নিয়ে জামাতে তারাবীর নামাজ আদায় করি। তিনি উমার রা.বলেছিলেন, লোকেরা তো দিনভর রোজা রাখে, তবে তারা সুন্দরভাবে কুরআন তেলাওয়াত করতে পারে না। তুমি যদি তাদেরকে কুরআন পড়ে শোনাতে! উবাই রা.তখন বললেন- আমীরুল মুমিনীন! এ তো এমন এক কাজ, যা ইতিপূর্বে করা হয়নি! উমর রা. বলেন, আমি তা জানি, তবে তা উত্তম হবে। তখন উবাই রা.লোকদের নিয়ে বিশ রাকাত নামাজ আদায় করলেন। [যিয়াউদ্দীন মাকদিসী আলহাম্বালী, আল আহাদীসুল মুখতারা, হাদীস-১১৬১.এর সনদ হাসান]
® কিতাবের নাম” মুত্তা মালেক” অধ্যায়- “রমজানের নামাজ” শিরোনাম-‘রমজানে রাত জাগা’
موطأ مالك كِتَابُ الصَّلَاةِ فِي رَمَضَانَ، بَابُ مَا جَاءَ فِي قِيَامِ رَمَضَانَ، بْنِ رُومَانَ بضم الراء المدني الثقة المتوفى سنة ثلاثين ومائة-
عَنْ يَزِيدَ بْنِ رُومَانَ قَالَ كَانَ النَّاسُ يَقُومُونَ فِي زَمَانِ عُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ فِي رَمَضَانَ بِثَلَاثٍ وَعِشْرِينَ رَكْعَةً.
উপরোক্ত শিরোনামে ইমাম মালেক রহ. ইয়াযীদ বিন রুমান যার মৃত্যু-১১৩হিজরী। সূত্রে বর্ণানা করেন যে,তিনি (ইয়াযীদ বিন রুমান রা).বলেন-মানুষরা রমজান মাসে উমার ইবনে খত্তাব রা.এর যোগে তেইশ রাকাত নামাজ রাত জেগে আদায় করতেন।
★ عن عبد العزيز بن رفيع قال كَانَ أُبَيُّ بنُ كَعبٍ يُصَلِّي بِالنَّاسِ فِي رَمَضَانَ بِالمَدِينَةِ عِشرِينَ رَكعَةً ، وَيُوتِرُ بِثَلاثٍ٠
আব্দুল আজিজ ইবনে রাফিঈ রহ.হতে বর্ণিত,উবাই ইবনে কাব রা. মানুষদের নিয়ে রমজানে বিশ রাকাত তারাবীর নামাজ পড়াতেন,অত:পর তিন রাকাত ভিতরের নামাজ পড়াতেন। [ ইবনে আবি শাইবা-৭৭৬৬ সনদ মুরসল]
★ইমাম তিরমযী রহ.তার কিতাব “সুন্নাহ” তৃতীয় খন্ডের ১৬৯ নং পৃষ্ঠায় লিখেন-
وَأَكْثَرُ أَهْلِ الْعِلْمِ عَلَى مَا رُوِيَ عَنْ عُمَرَ وَعَلِيٍّ وَغَيْرِهِمَا مِنْ أَصْحَابِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عِشْرِينَ رَكْعَةً وَهُوَ قَوْلُ الثَّوْرِيِّ وَابْنِ الْمُبَارَكِ وَالشَّافِعِيِّ .وقَالَ الشَّافِعِيُّ وَهَكَذَا أَدْرَكْتُ بِبَلَدِنَا بِمَكَّةَ يُصَلُّونَ عِشْرِينَ رَكْعَةً .
অধিকাংশ আলেম যারা হযরত উমার, আলী ও অন্যান্য সাহাবা রা.গন হতে মত প্রকাশ করেছেন যে,তারাবী বিশ রাকাত। তিনি আরও বলেন যে,এটি ইমাম সাওরী, ইবনে মোবারক ও ইমাম শাফী রহ.দের মত। ইমাম শাফী রহ.বলেন আমদের শহর মক্কায় ও বিশ রাকাত আদায় করতে দেখা যায়।
جمعهم عمر ابن خطاب رضى الله عنه على ابى بن كعب ،وكان يصلى بهم عشرين ركعة ويوتربثلاث
উমর ইবনে খত্তাব রা.এক ইমামে উবাই ইবনে কাব রা. এর পিছনে সবাইকে একত্রিত করে দিলেন। তিনি (উবাই ইবনে কাব রা.)তারবীর নামাজ পড়াইতেন বিশ রাকাত,আর বিতরের নামাজ পড়াইতেন তিন রাকাত।[আল ফাতওয়া আল মিশরিয়া-২খন্ড,৪০১পৃষ্ঠা]
كان عمر رضي الله عنه جمعهم على امام واحد وهو ابى ابن كعب رضى الله عنه،اتعلم من ابى ابن كعب رضى الله عنه؟ الذى جمع الناس عليه بامر عمرابن خطاب رضى الله عنه اتعلم من عمرابن خطاب رضى الله عنه؟الذى هو احد خلفاء الراشدة وقال لهم رسول الله صلى الله عليه وسلم ،عليكم بسنتى وسنتى خلفاء الراشدين،
(তারাবীর নামাজের জন্য) উমর রা.এক ইমামের পিছনে সবাইকে একত্রিত করে দিলেন আর ঐ ইমাম হচ্ছেন উবাই ইবনে কাব।তোমরা কি জান উবাই ইবনে কাব কে? তিনি হচ্ছেন যার পিছনে মানুষদেরকে একত্রিত হয়ে নামাজ আদায়ের নির্দেশ দিয়ে ছিলেন উমার রা. আর তোমারা কি জান উমার বিন খত্তাব কে?তিনি হচ্ছেন খুলাফায়ে রাশেদার একজন। যাদের বিষয়ে রাসূল সা. বলেছিলেন -তোমারা আমার সুন্নাত ও আমার খুলাফায়ে রাশেদার সুন্নতকে আকড়ে ধর।[আল ফাতাওয়া লি ইবনে তাইমিয়া-খন্ড-২২,পৃষ্ঠা -২৩৪]
তার পারে ইবনে তাইমিয়া রহ.নিম্নোক্ত হাদিসটি উল্লেখ করেন।
قَالَ حَدَّثَنِي عَبْدُ الرَّحْمَنِ بْنُ عَمْرٍو السُّلَمِيُّ، وَحُجْرُ بْنُ حُجْرٍ، قَالاَ أَتَيْنَا الْعِرْبَاضَ بْنَ سَارِيَةَ وَهُوَ مِمَّنْ نَزَلَ فِيهِ { وَلاَ عَلَى الَّذِينَ إِذَا مَا أَتَوْكَ لِتَحْمِلَهُمْ قُلْتَ لاَ أَجِدُ مَا أَحْمِلُكُمْ عَلَيْهِ } فَسَلَّمْنَا وَقُلْنَا أَتَيْنَاكَ زَائِرِينَ وَعَائِدِينَ وَمُقْتَبِسِينَ. فَقَالَ الْعِرْبَاضُ صَلَّى بِنَا رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم ذَاتَ يَوْمٍ ثُمَّ أَقْبَلَ عَلَيْنَا فَوَعَظَنَا مَوْعِظَةً بَلِيغَةً ذَرَفَتْ مِنْهَا الْعُيُونُ وَوَجِلَتْ مِنْهَا الْقُلُوبُ فَقَالَ قَائِلٌ يَا رَسُولَ اللَّهِ كَأَنَّ هَذِهِ مَوْعِظَةُ مُوَدِّعٍ فَمَاذَا تَعْهَدُ إِلَيْنَا فَقَالَ أُوصِيكُمْ بِتَقْوَى اللَّهِ وَالسَّمْعِ وَالطَّاعَةِ وَإِنْ عَبْدًا حَبَشِيًّا فَإِنَّهُ مَنْ يَعِشْ مِنْكُمْ بَعْدِي فَسَيَرَى اخْتِلاَفًا كَثِيرًا فَعَلَيْكُمْ بِسُنَّتِي وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الْمَهْدِيِّينَ الرَّاشِدِينَ تَمَسَّكُوا بِهَا وَعَضُّوا عَلَيْهَا بِالنَّوَاجِذِ وَإِيَّاكُمْ وَمُحْدَثَاتِ الأُمُورِ فَإِنَّ كُلَّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ وَكُلَّ بِدْعَةٍ ضَلاَلَةٌ.
আবদুর রহমান ইবনু আমর আস-সুলামী ও হুজর ইবনু হুজর রা.থেকে বর্ণিত, একদা আমরা আল-ইরবাদ ইবনু সারিয়াহ রা.এর নিকট আসলাম। যাদের সম্পর্কে এ আয়াত নাযিল হয়েছে তিনি তাদের অন্তর্ভুক্ত “তাদেরও কোন অপরাধ নেই যারা তোমার নিকট বাহনের জন্য এলে তুমি বলেছিলে-আমি তোমাদের জন্য কোন বাহনের ব্যবস্থা করতে পারছি না” (সূরাহ তাওবাহ-৯২)। আমরা সালাম দিয়ে বললাম, আমরা আপনাকে দেখতে, আপনার অসুস্থতার খবর নিতে এবং আপনার কাছ থেকে কিছু অর্জন করতে এসেছি।আল-ইরবাদ রা.বললেন, একদিন রাসুল সা.আমাদেরকে সঙ্গে নিয়ে সলাত আদায় করলেন, অতঃপর আমাদের দিকে ফিরে আমাদের উদ্দেশে জ্বালাময়ী ভাষণ দিলেন, তাতে চোখগুলো অশ্রুসিক্ত হলো এবং অন্তরগুলো বিগলিত হলো। তখন এক ব্যক্তি বললেন, হে আল্লাহ্র রাসুল! এ যেন কারো বিদায়ী ভাষণ! অতএব আপনি আমাদেরকে কি নির্দেশ দেন? তিনি বলেন-আমি তোমাদেরকে আল্লাহভীতির, শ্রবণ ও আনুগত্যের উপদেশ দিচ্ছি, যদিও সে আমীর একজন হাবশী গোলাম হয়। কারণ তোমাদের মধ্যে যারা আমার পরে জীবিত থাকবে তারা অচিরেই প্রচুর মতবিরোধ দেখবে। তখন তোমরা অবশ্যই আমার সুন্নাত এবং আমার হিদায়াতপ্রাপ্ত খলীফাগণের সুন্নাত অনুসরণ করবে, তা দাঁত দিয়ে কামড়ে আঁকড়ে থাকবে। সাবধান! (ধর্মে) প্রতিটি নবাবিষ্কার সম্পর্কে! কারণ প্রতিটি নবাবিষ্কার হলো বিদআত এবং প্রতিটি বিদআত হলো ভ্রষ্টতা।[তিরমিযী-২৬৭৬, আবূ দাঊদ ৪৬০৭,আহমাদ ১৬৬৯২, ইবনে মাজা-৪৪]
® তিনি ইবনে তাইমিয়া রহ.বলেন উমার রা.যা করছেন তা হচ্ছে সুন্নাহ।
© সৌদি আরবের প্রধান মুফতী ও প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ ইবনে ইবরাহীম রহ. লিখেছেন
عمر رضي الله عنه لما جمع الناس على أُبي بن كعب كان يصلي بهم عشرين ركعة، وكان هذا بمحضر من الصحابة، فيكون كالإِجماع
অর্থাৎ উমর রা. যখন লোকদেরকে উবাই ইবনে কাব রা.এর পেছনে একত্রিত করে দিলেন, তখন তিনি তাদেরকে নিয়ে বিশ রাকাত নামায পড়তেন। আর তা ছিল সাহাবীদের উপস্থিতিতেই। ফলে তা ইজমার মতোই হয়ে যায়। [ফাতাওয়া ওয়া রাসায়েল, ২/১৯৬, শামেলা সংস্করণ]
৪.উচমান রা.এর যোগ:-
ইমাম বায়হাকী রহ.তার কিতাবে একটা শিরোনাম লিখেছেন –
باب عددركعات القيام فى رمضان: –
রমজানে তারাবীর রাকাতের সংখ্যার অধ্যায়:-
عن السائب بن يزيد قال كانوا يقومون على عهد عمر بن الخطاب في شهر رمضان بعشرين ركعة وكانوا يقرأون بالمئين وكانوا يتوكؤون على عصيهم في عهد عثمان من شدة القيام.
وإسناده صحيح كما قال النووي في المجموع ورواه مالك في الموطأ.
সায়েব ইবনে ইয়াজিদ রা.বলেন-তারা উমার রা.এর খিলাফত আমলে রমজানের তারাবীর নামাজ বিশ রাকাত পড়তেন। উচমান রা.এর খেলাফত আমলে প্রতি রাকাতে ইমাম সাহেবরা দুইশ আয়াতের অধিক পড়ত বলে মুসল্লী রা তাদের লাঠিতে ঠেক লাগাতেন। বেশীক্ষণ দাড়াতে কষ্ট হত বলে।
® ইমাম নববী রহ.এই সনদ বিশুদ্ধ বলেছেন। অনুরূপ বর্নানা ইমাম মালেক রহ.তার মুয়াত্তা কিতাবও এনেছেন।
৫.আলী রা.এর যোগ:-
পূর্বের মত ইমাম বায়হাকী রহ.তার কিতাবে একটা শিরোনাম লিখেছেন –
باب عددركعات القيام فى رمضان: –
রমজানে তারাবীর রাকাতের সংখ্যার অধ্যায়:-
এতে তিনি একটি বর্ণানা এনেছেন যে,-
عن أبي عبد الرحمن السلمي عن علي رضي الله عنه قال دعا أي علي رضي الله عنه القراء في رمضان فأمر منهم رجلا يصلي بالناس عشرين ركعة قال وكان علي رضي الله عنه يوتر بهم.
আবি আব্দুর রহমান আস সুলামী রহ.হতে বর্নিত,তিনি বলেন আলী রা. রমজান মাসে কারী ইমাম সাহেবদের ডাকতেন।তাদেরকে বিশ রাকাত তারাীর নামাজ পড়াতে নির্দেশ দিতেন এবং নিজে তাদেরকে ভিতরের নামাজ পড়াইতেন।
★বিশেষ দ্রষ্ঠব্য।
উপরোক্ত বিশ রাকাত তারাবীর বিষয়ে ১২৮৪ হিজরী সন পর্যন্ত কোন আপত্তি ছিলনা।
চারজন ব্যাক্তি যথা-১.ইমাম মুহাম্মদ বিন নসর আল মারওয়াজী মৃত্যু -২৯৪ হিজরী।
তিনি একটা কিতাব লিখেছিলেন যার নাম-“কিয়ামি রমজান” তিনি তার কিতাবে তারবীর নামাজ নিয়ে অনেক আলোচনা করেছেন কিন্তু তিনি তার কিতাবের কোন স্থানে তারাবীর রকাতের সংখ্যা নিয়ে কোন আলোচনা করেন নি।
২.ইমাম তাকি উদ্দিন আস সুবকী রহ.মৃত্যু -৭৫৬হিজরী।তিনি একটি কিতাব লিখেন যার নাম-“ইশরাকীল মসাবিহ ফি সালাতীত তারাবীহ” তিনিও তার কিতাবে তারাবীর তাৎফর্জ,ফজিলত ও অনান্য বেশ কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন কিন্তু রাকাতের সংখ্যা নিয়ে কোন আলোচনা করেন নি।
৩.ইমাম কাসেম ইবনে কুতলুবুগা রহ.মৃত্যু -৮৭৯হিজরী। তার লিখিত কিতাবেন নাম”মজমু আতুর রসায়েল” তিনিও তারিবী বিশের কম কিনা তার কোন আলোচনা করেন নি।
৪.ইমাম জলাল উদ্দীন সূয়োতী রহ.মৃত্যু-৯১১হিজরী। তার লিখিত কিতাবের নাম “আল মসাবিহী ফিসাতিত তারাবীহ” তিনি তারাবী বিশ রাকাতের কম-বেশী কোন আলোকপাত করেন নি।
★আট রাকাত তারাবীর সূচনা যেভাবে –
রাসূল সা.মাঝেমধ্যে সাহাবায়ে কেরামকে নিয়ে তারাবী পড়েছেন। কত রাকাত পড়েছেন তা সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্টভাবে কোন বিশুদ্ধ সূত্রে জানা যায় না। তবে হযরত উমর রা. এর খেলাফতকাল থেকে এখন পর্যন্ত বিশ রাকাত তারাবী পড়া হয়ে আসছে। এ দীর্ঘ সময় কোথাও আট রাকাত পড়ার প্রচলন ছিল না। উম্মতের এ অবিচ্ছিন্ন কর্মধারাই প্রমাণ করে যে, নবী সা.এর কাছ থেকে সাহাবায়ে কেরাম বিশ রাকাতের তালিমই পেয়েছিলেন।
★আট রাকাত তারাবী’র সূচনা:-
আহলে হাদীস আলেমরাও প্রথম প্রথম বিশ রাকাত তারাবী পড়ে গেছেন। সর্বপ্রথম ১২৮৪ হিজরী সালে ভারতের আকবরাবাদ থেকে এদের একজন আট রাকাত তারাবীর ফতোয়া দেন। তীব্র প্রতিবাদের মুখে সেই ফতোয়া টিকতে পারেনি। এরপর ১২৮৫ হিজরীতে পাঞ্জাব সীমান্তে মাওলানা মুহাম্মদ হুসাইন বাটালবী নামে এদের আরেক জন ফতোয়া দেন যে, আট রাকাত তারাবী পড়া সুন্নত। বিশ রাকাত পড়া বেদাত। বলা হয়, পাঞ্জাবের অনেক স্থানে তার মাধ্যমেই আট রাকাত তারাবীর প্রচলন শুরু হয়। তার ফতোয়ারও তীব্র বিরোধিতা হয়। এমনকি তাদেরই একজন বিখ্যাত আলেম মাওলানা গোলাম রাসূল রহ.ঐ ফতোয়ার খণ্ডনে ‘‘রিসালা তারাবী’’ নামে একটি পুস্তিকা রচনা করেন। ১২৯১ সালে সেটি প্রকাশিত হয়।[দ্র. রাসায়েলে আহলে হাদীস, ২খ, ২৮ পৃ]
হাফেজ আব্দুল্লাহ গাজীপুরী ও মাওলানা আব্দুর রহমান মোবারকপুরী সহ এদের আরো কিছু আলেমও একই ফতোয়া প্রচার করতে থাকেন।
★আরবের অবস্থা
ভারতবর্ষের পরে এখানকার লা-মাযহাবী আলেমদের প্রভাবে আরবেও দুএকজন আটের ফতোয়া দিতে শুরু করেন। হারামাইন শরীফাইন তথা বাইতুল্লাহ শরীফ ও মসজিদে নববীতে বিশ রাকাত তারাবী অব্যাহত থাকলেও সর্বপ্রথম আরবে শায়খ নসীব রেফায়ী একটি পুস্তিকা লিখে আট রাকাতের ফতোয়াকে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন। শায়খ নাসীরুদ্দীন আলবানীও তার সমর্থন করেন। এর খণ্ডনে আরব জাহানের কয়েকজন আলেম কলম ধরেন। একাধিক আলেমের রচনার সমষ্টি-
الإصابة في الانتصار للخلفاء الراشدين والصحابة
নামে প্রকাশিত হয়। সেখানে তাঁরা লিখেছেন-
ولم يشذ أحد منهم بمنعها غير هذه الشرذمة القليلة التي ظهرت في زماننا كالشيخ ناصر وإخوانه
অর্থাৎ আমাদের যুগে আত্মপ্রকাশকারী নাসিরুদ্দীন (আলবানী) ও তার সমর্থকদের ক্ষুদ্র একটি অংশ ছাড়া কেউই অনুরূপ ফতোয়া দিয়ে বিচ্ছিন্নতা অবলম্বন করেননি।[দ্র, পৃ, ৬১]
এ পুস্তিকাটির খণ্ডনে আলবানী রহ. ‘তাসদীদুল ইসাবাহ’ নামে একটি পুস্তিকা রচনা করে ১৩৭৭ হি. সালে প্রকাশ করেন। কিন্তু উক্ত গ্রন্থেও তিনি সাহাবী, তাবেয়ী, তাবে-তাবেয়ীগণের কোন একজনকেও দেখাতে পারেননি, যিনি আট রাকাত তারাবীর কথা বলেছেন। এমনিভাবে এমন কোন ঐতিহাসিক মসজিদের নজিরও দেখাতে পারেননি যেখানে আট রাকাত তারাবী হতো।
আলবানী রহ.এর পুস্তিকাটির যথোপযুক্ত জবাব দিয়েছেন সৌদি আরবের কেন্দ্রীয় দারুল ইফতার সাবেক গবেষক মুহাদ্দিস শায়খ ইসমাঈল আনসারী। তার কিতাবটির নাম-‘‘তাসহীহু হাদীসি সালাতিত তারাবী ইশরীনা রাকআতান ওয়ার রাদ্দু আলাল আলবানী ফী তাযয়ীফিহী’’। একইভাবে সৌদি আরবের বিখ্যাত আলেম, মসজিদে নববীর প্রসিদ্ধ মুদাররিস ও মদীনা শরীফের সাবেক কাযী শায়খ আতিয়্যা সালিম ‘‘আত তারাবীহ আকছারু মিন আলফি আম’’ নামে একটি মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেন।
সৌদির আরেকজন খ্যাতনামা আলেম, বহুগ্রন্থ প্রনেতা শায়খ মুহাম্মদ আলী সাবূনী রহ.ও এ বিষয়ে ‘‘আত তারাবী ইশরূনা রাকআতান’’ নামে আরেকটি গ্রন্থ রচনা করেন। আর লা-মাযহাবী আলেম মোবারকপুরী সাহেবের খণ্ডনে কলম ধরেছেন বিগত শতকের সেরা মুহাদ্দিস মাওলানা হাবীবুর রহমান আজমী রহ. মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক, সুনানে সাঈদ ইবনে মানসূর, মুসনাদে হুমায়দী সহ বহু হাদীসগ্রন্থ সম্পাদনাপূর্বক যিনি পৃথিবীর মুখ দেখিয়েছেন এবং আরব বিশ্বের বড় বড় আলেম শায়খ মুসতাফা যারকা, শায়খ আব্দুল আযীয বিন বায, শায়খ আব্দুল ফাত্তাহ আবূ গুদ্দাহ, নাসিরুদ্দীন আলবানী প্রমুখ যার কাছ থেকে হাদীসের ইজাযত হাসিল করেছেন। ‘‘রাকআতে তারাবী’’ নামে উর্দূ ভাষায় তিনি অত্যন্ত সারগর্ভ ও তথ্যসমৃদ্ধ গ্রন্থ রচনা করেন। এটি সর্বপ্রথম ১৩৭৬ হিজরী সালে প্রকাশিত হয়।[সূত্র:দলিলসহ নামাযের মাসায়েল, (শিরোনাম : তারাবী বিশ রাকাত পড়া সুন্নত), লেখক : মাওলানা আবদুল মতিন, প্রকাশক : মাকতাবাতুল আযহার, ঢাকা]
★রাসূল সা.আট রাকাত তারাবী পড়েছেন বিষয়টি প্রমাণিত নয়:-
আট রাকাতের পক্ষের দলিল :
عَنْ أَبِي سَلَمَةَ بْنِ عَبْدِ الرَّحْمَنِ، أَنَّهُ سَأَلَ عَائِشَةَ رضى الله عنها كَيْفَ كَانَتْ صَلاَةُ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم فِي رَمَضَانَ فَقَالَتْ مَا كَانَ يَزِيدُ فِي رَمَضَانَ، وَلاَ فِي غَيْرِهَا عَلَى إِحْدَى عَشْرَةَ رَكْعَةً، يُصَلِّي أَرْبَعًا فَلاَ تَسَلْ عَنْ حُسْنِهِنَّ وَطُولِهِنَّ، ثُمَّ يُصَلِّي أَرْبَعًا فَلاَ تَسَلْ عَنْ حُسْنِهِنَّ وَطُولِهِنَّ، ثُمَّ يُصَلِّي ثَلاَثًا. فَقُلْتُ يَا رَسُولَ اللَّهِ، أَتَنَامُ قَبْلَ أَنْ تُوتِرَ قَالَ يَا عَائِشَةُ إِنَّ عَيْنَىَّ تَنَامَانِ وَلاَ يَنَامُ قَلْبِي.
আবূ সালামা ইবনু আবদুর রাহমান রহ. থেকে বর্ণিত,তিনি আয়িশা রা.কে জিজ্ঞেস করেন যে, রমযানে রাসূল সা. এর সালাত কিরূপ ছিল? তিনি বললেন, রমযান মাসে ও রমযানে ব্যতীত অন্য সময়ে রাতে তিনি এগার রাকআত হতে বৃদ্ধি করতেন না। তিনি চার রাকআত সালাত আদায় করতেন, তুমি তার সৌন্দর্য ও দীর্ঘতা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করো না। অতঃপর তিনি চার রাকআত পড়েন। তুমি তার সৌন্দর্য ও দীর্ঘতা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করো না। এরপর তিন রাকআত সালাত আদায় করতেন। আমি আয়িশা রা. বললাম, হে আল্লাহর রসূল! আপনি বিতর আদায়ের আগে ঘুমিয়ে যাবেন? তিনি বললেন-হে আয়িশা! আমার দুচোখ ঘুমায় বটে কিন্তু আমার কালব নিদ্রাভিভূত হয়না।[বুখারী-২০১৩]
এ হাদীস দিয়ে দুইভাবে আট রাকাত তারাবী প্রমাণ করা যেতে পারে।
এক. হযরত আয়েশা রা.কে রমযানের রাতের নামায সম্পর্কে জিজ্ঞেস করার পরই তিনি আট রাকাত নামাযের কথা বলেছেন। আর বলাবাহুল্য, রমযানের রাতের বিশেষ নামায তো তারাবীর নামায-ই।
দুই. ইমাম বুখারী রহ. এ হাদীস বর্ণনা করেছেন তারাবীর নামায শীর্ষক পরিচ্ছেদে। ফলে কেউ সহজেই এ হিসাব মিলাতে পারে-রমযানের রাতে আট রাকাত তারাবী পড়ার বিষয়টি সরাসরি রাসূল সা.থেকেই প্রমাণিত। তাই যদি হয়, তবে আমরা বিশ রাকাত পড়ব কেন? প্রশ্নটি এভাবেও করা যায়-রাসূল সা.থেকে আট রাকাত তারাবীর এমন সহীহ বর্ণনা থেকে থাকে, তবে কী করে তাঁর পরবর্তীতে সাহাবী-তাবেয়ীগণ কোনোপ্রকার মতবিরোধ ছাড়াই বিশ রাকাত তারাবী মেনে নিলেন? পরবর্তীতেও কীভাবে হাজার বছরের অধিক কাল ধরে বিশ রাকাত তারাবীর আমল চর্চিত হয়ে আসছে? এমন স্পষ্ট সহীহ হাদীসের এমন বিরোধিতা কি কল্পনা করা যায়!
এ হাদীসের মূল মর্ম:
একটু গভীর দৃষ্টিতে দেখলেই বোঝা যাবে এ হাদীস আট রাকাত তারাবীর দলিল হতে পারে না। এখানে বরং তাহাজ্জুদের নামাযের কথা বলা হয়েছে। লক্ষ করুন-
এক.
হযরত আয়েশা রা.স্পষ্টই বলেছেন রমযানে ও রমযানের বাইরে তিনি এগার রাকাতের বেশি পড়তেন না। বোঝা গেল, এটা এমন কোনো নামায হবে, যা সারা বছরই পড়া হয়, শুধুই রমযানে নয়। আর তা হলো তাহাজ্জুদের নামায, তারাবীর নামায নয়।
দুই.
এ হাদীসে রাসূল সা.এর একাকী নামাযের বিবরণ রয়েছে। একাকী বিতির পড়ার বিবরণ রয়েছে। অথচ তারাবীর নামায জামাতে পড়া হয়, তারাবীর পর বিতিরও জামাতে পড়া হয়। একাকী পড়া হয় তাহাজ্জুদের নামায।
তিন.
আট রাকাত তারাবীর পক্ষে যদি এত সুস্পষ্ট দলিল থাকত, তবে সাহাবায়ে কেরাম থেকে শুরু করে হাজার বছরের ইতিহাসে এমন অনেক ফকীহ ও মুজতাহিদ থাকতেন, যারা আট রাকাত তারাবীর কথা বলতেন এবং বিশ রাকাত তারাবীকে প্রত্যাখ্যান করতেন। কিন্তু কোনো সাহাবী-তাবেয়ী, কোনো ফকীহ- মুজতাহিদ আট রাকাতের মত ব্যক্ত করেননি। তারা বরং প্রায় সকলেই বিশ রাকাতের কথা বলেছেন। কেউ কেউ অবশ্য ৩৬ বা ৩৮ রাকাতের কথাও বলেছেন। বোঝা গেল, তাদের দৃষ্টিতে এ হাদীস তারাবীর নয়, তাহাজ্জুদের।
চার.
এ হাদীসটি যেমন সহীহ, তেমনি প্রসিদ্ধও। হাদীসের বিখ্যাত অনেক কিতাবেই তা উদ্ধৃত হয়েছে। ইমাম বুখারী রহ.এর পাশাপাশি ইমাম মালিক, ইমাম মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিযী, নাসায়ী, আবদুর রাযযাক, দারিমী, আবু আওয়ানা, ইবনে খুযায়মা রহ. প্রমুখ এ হাদীসটিকে স্ব স্ব কিতাবে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু তারা কেউই একে কিয়ামু রমাযান বা তারাবীর অধ্যায়ে উল্লেখ করেননি। বরং তারা এ হাদীস তাহাজ্জুদের অধ্যায়ে উল্লেখ করেছেন। [উল্লেখ্য, তারাবীর নামাযের শিরোনাম হচ্ছে কিয়ামু রমাযান আর তাহাজ্জুদের শিরোনাম কিয়ামুল্লাইল বা সালাতুল্লাইল।]
একমাত্র ইমাম বুখারী রহ. এ হাদীসকে তারাবীর অধ্যায়ে উল্লেখ করেছেন। তিনি অবশ্য হাদীসটিকে তাহাজ্জুদের অধ্যায়েও উল্লেখ করেছেন। হাদীসের ছাত্রদের কাছে বিষয়টি অজানা নয় ইমাম বুখারী রহ. খুব সামান্য মুনাসাবাত বা সম্পর্কের ভিত্তিতেও কোনো শিরোনামের অধীনে হাদীস উল্লেখ করেছেন। তাই এখানে এমনও হতে পারে, তিনি বোঝাতে চেয়েছেন, রমযানে তারাবীর নামায তো যা পড়ার পড়বেই। এরপর তাহাজ্জুদও পড়া উচিত। কেননা রাসূল সা.সারা বছরই এ তাহাজ্জুদের নামায আদায় করতেন।
পাঁচ.
এ হাদীস যদি তারাবীর নামায সংক্রান্ত হতো, তবে সাহাবায়ে কেরামের পক্ষে এর বিপরীতে গিয়ে একমত হয়ে যাওয়া সম্ভব হতো না। তারা কেউ না কেউ এর প্রতিবাদ করতেনই। হযরত আয়েশা রা.এর চোখের সামনেই তো বিশ রাকাত তারাবী পড়া হলো প্রায় ৪০ বছর। কিন্তু কোনো প্রতিবাদ তিনিও করলেন না। সাহাবীগণ সম্পর্কে যাদের সামান্য জানাশোনাও আছে, তারা জানেন, শরিয়তের ক্ষেত্রে তারা কতটা কঠোর ছিলেন। নবীজি সা. এর শিক্ষাবিরোধী কোনো কিছু তারা কখনোই মেনে নিতে পারতেন না।
ছয়.
আহলে হাদীস ঘরানার আলেম নওয়াব সিদ্দীক হাসান খান রহ. বলেছেন :
لم يأت تعيين العدد في الروايات الصحيحة المرفوعة
অর্থাৎ সহীহ মারফু হাদীসে (তারাবীর নামাযের) রাকাত সংখ্যা নির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়নি। [আলইনতিকাদুর রাজীহ, পৃ. ৬১ এর সূত্রে, দলিলসহ নামাযের মাসায়েল, পৃ. ৪৪০]
আট রাকাতের উপরোক্ত হাদীস যদি তারাবীর নামাযের হাদীসই হতো, তবে এমন সহীহ মারফু হাদীস থাকার পরও নওয়াব সিদ্দীক হাসান খান রহ. কেন এমন কথা বলবেন?
উপরোক্ত বিষয়গুলো সামনে রেখে নির্দ্বিধায় এ কথা বলা যায়, রাসূল সা.আট রাকাত তারাবী পড়েছেন,বিষয়টি আদৌ প্রমাণিত নয়। আট রাকাতের এ হাদীস তাহাজ্জুদের নামাযের হাদীস, তারাবীর নামাযের নয়। মহান আল্লাহ আমাদেরকে সঠিক বুঝ দান করুন-আমিন।